সাদা ও কালো
সাদা আর কালো নিয়ে ইদানীং বেশ এক প্রস্থ কথা হল। যদিও সোশাল মিডিয়ার বহুল চর্চিত হওয়ার দুটি কারণ ছিল এক বর্তমান আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ আর দুই বহুদিনের পরিচিত ক্রিম ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির নাম পরিবর্তন। প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি ঘটনা নিয়েই একাধিক মানুষ তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। আমার সেই সব নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে এই বিষয়ে আমার দীর্ঘদিনের লম্বা কিছু ধারনা বা বলা ভাল তথ্য আরোহণ আর সেই নিয়ে নিজের চিন্তাই তুলে ধরতে চাই।
যদি ভারতীয় সভ্যতার দিকে তাকান তবে দেখা যাবে যে সেখানে কিন্তু সৃষ্টির আদি বলতে মহাশূন্য এবং মূল সৃষ্টি কারি দেবী হিসাবে দেবী চণ্ডী , কালিকা এঁদের দেখিয়েছে। আবার যখন পরবর্তী কালে বিগ ব্যাং থিওরি আসে সেখানেও কিন্তু বলা হয়েছে সৃষ্টি হচ্ছে যে মহাশূন্য থেকে তাও কিন্তু কালো বা কৃষ্ণ।
আর এক্ষেত্রেও ভারতের আদি নিবাসী যারা যাদের মূলত অনার্য বলা হয় তাঁদের একাধিক দেবতাদের পরবর্তীকালে আর্য দেবতাদের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ একত্র করন হয়েছে। সেটা অনেকটাই ভারতের মাটিতে আর্য আর অনার্যদের মিশে যাওয়ার মতনই। যদিও এখন একটা বড় অংশ প্রোপাগান্ডা বানায় যে আর্য নামের জাতটা বাইরে থেকে ভারতে আসেনি। যদিও ইতিহাস আর গবেষণা সে কথা বলেনা। মধ্য প্রাচ্য থেকে আগত যাযাবরদের এক অংশ এই আর্য যারা ভারতের মাটিতে এখানকার আদি মানুষদের সাথে মিশে যান। আর বৈদিক সভ্যতাও এঁদের দান। আর ভারতের দুই মহাকাব্যে এই মিশ্রন প্রকিয়াটি দেখানো হয়েছে বেশ ভাল করে। চোখ থেকে ধর্মনামের ঠুলি সরিয়ে যদি সাহিত্য ও গবেষনার জন্য পড়া হয় তবে সেই সব সুস্পষ্ট ভাবে দেখা যাবে। যদিও সেই সংমিশ্রণ ও মহাকাব্যের কথা অন্য কোন আর্টিকেলে বলব। আপাতত ফিরে আসি সাদা আর কালোয়।
আর এখানেও অন্য প্রতিপাদ্যে যাওয়ার আগে এই মহাকাব্যের কিছু প্রধান চরিত্রের গাত্র বর্ন নিয়ে একটু কিছু না বল্লেই নয়। মহাভারতের যে রচয়িতা ব্যাস দেব তাঁর আসলনাম কৃষ্ণ, যমুনার দ্বীপে মৎসগন্ধ্যা( তখনও পর্যন্ত সত্যবতী এই নামেই পরিচিত ছিলেন) ও ঋষি পরাশরের সন্তান জন্ম নেন নাম হল তাও দ্বৈপায়ন। আর গাত্র বর্নের জন্য সে কৃষ্ণ পরবর্তীকেলা বেদ বিন্যাস করেন বলে বেদব্যাস। আবার তাঁর নাতিদের দিকে যদি তাকানো যায় তবে অর্জুনের গায়ের রঙও কালো। আর মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র স্বয়ং কৃষ্ণও কালোই। আবার দ্রৌপদী নিজেও কালো তাই সে কৃষ্ণা যদিও মহাভারতের অনেক সমালোচক মনে করেন যে সে কৃষ্ণের বন্ধু বলে কৃষ্ণা কিন্তু আদতে তা না যজ্ঞবেদী থেকে উত্থানের সময়েই তাঁর গাত্রবর্ন্র উল্লেখ আছে সেখানে থেকেই সে কৃষ্ণা। কিন্তু মূল মাহাভারত ও মহাভারতের সমালোচকরা এসব বল্লেও বর্তমান টিভি সিরিয়াল এঁদের সবাই কে সাদা না বলা ভাল ক্যাটকেটে ফর্সা করে দেয়। এখানেই প্রশ্ন আসে কেন? একী চিরকালীন বা বলা ভাল দুশ বছরের ইংরেজ প্রভুদের জন্য মানে তাঁদের জন্য সবাইকে সাদা করতে হবে? যদিও টিভি যুগের প্রথম রামায়ন বা মহাভারতে এই চরিত্র গুলিকে ফর্সা দেখানো হয়নি। এমনকি উত্তর ভারতে জন্মানো রামচন্দ্র নিজেও ফর্সা ছিলেন না তাঁকেও দূর্বাদল বর্নের বলা হয়েছে নীল এখানে সেটিও কি তাঁর ফর্সা না হওয়ার ইংগিতই বহন করে না?
আর ভারতবর্ষের মানুষদের রঙ ফর্সা হলেও সেটা বাদামী আভা সহ। যার মূল কারণ অবশ্যই জলবায়ূ আর প্রাকৃতিক অবস্থান।
এত গেল ভারতের সাহিত্য আর মানুষদের গায়ের রঙের কথা। এবার যদি আমরা একটি বর্তমানের গবেষনা দেখি যা করা হচ্ছে যীশুকে নিয়ে সেখানেও কিন্তু যীশুর গায়ের রঙ বাদামীই বলা হচ্ছে। যদিও আমরা চিরকালই যীশুকে ফর্স দেখতেই অভ্যসত। আসলে বলা হচ্ছে যে যীশুর জন্ম কিন্তু ইউরোপিয়ান দেশে না সে যেখানে জন্মেছে সে দেশের মানুষদের গায়ের রঙ ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা হয়না একটা বাদামী আভা থাকে। তাহলে তিনি ফর্সা হলেন কী করে? এখানে বলা হচ্ছে যে তাঁকে ফর্সা করা হয়েছে অনেক পরে। যখন তিনি খৃষ্ট ধর্মের সাথে সাথে একাধিক দেশে পারি দিয়েছেন তখন সেখানকার মানুষরা নিজদের গাত্র বর্ন অনুসারে তাঁকেও ফর্সা করেছে।
এক্ষেত্রে আমাদের গৌতম বুদ্ধকেও দেখতে হয়। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ হলেও তাঁর যে একাধিক মূর্তি আমরা দেখি তা কিন্তু পরবর্তী কালে সেই সব দেশে বৌদ্ধ দর্শন জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে সেখানকার মানুষদের সাথে মিল। আর এই মিল করাটা অস্বাভাবিক কিছুনা।
সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি ছেড়ে এবার যদি আমরা বিজ্ঞানের দিকে দেখি সেখানেও কিন্তু বলা হয়েছে যে আদি যে মানুষের মূল চামরা তাও কৃষ্ণ বর্নের। চামরার রঙ যত সাদা হবে আদতে তা নাকি খারাপ চামড়ার লক্ষণ।
আর এর পরে বলার যে এসবের পরেও মানুষের মনে কবে থেকে ‘ফর্সা’ হওয়ার হিরিক পরল আর ফর্সা না হলে সে খারাপ বা কালো ছেলে-মেয়েদের (বিশেষত মেয়েদের) বিয়ের সমস্যা জাতীয় জিনিস একাধিক বার চোখে পরে। এ সময়ে দাঁড়িয়েও কিন্তু সেই বিষয়টি কমেনি একটুও।
আবার যদি আমরা প্রথমেই যে আমেরিকার বিষয়টি বলেছিলাম সেখানেও যদি দেখি দেখা যাবে যে আদি আমেরিকার মানুষ কিন্তু কালো চামড়ারই। ভারতীয় উপমহাদেশের খোঁজে ভুলে ওখানে চলে যাওয়া সেই আমেরিকো ভেসপুচি কিন্তু সাদা চামড়ার। তবে বারংবার কী সেই সাদা আর কালোর দন্দ্ব এসে যায় প্রভু আর দাসের চক্করে?
অথচ ভারতের দেবদেবীরা নিজেরাই কৃষ্ণবর্নের। সাহিত্যে যতই লেখা হোক না কেন ‘কৃষ্ণ কলি আমি তাঁকে বলি যার কালো হরিণ চোখ’ আদতে আদি চামড়ার মানুষরা কী বারংবার সেই দাস আর প্রভুর চক্করে পরে বারংবার অন্যায়ের বর্নবিদ্বেষের স্বীকার হচ্ছে না?
প্রশ্ন থেকে যায় এখানেই যে তবে কেন আর কীসের জন্য আমাদের মধ্যেও সদা কালোর এই বিভেদ। আজকে যারা আমেরিকার ঘটনার নিন্দায় তাঁদের অনেকেই হয়ত নিজেরাও অনেক পছন্দের মানুষকে রিজেক্ট করে দেবে স্রেফ তাঁর গায়ের রঙ সাদা নয় বলে। এবং এই ধরনের ঘটনা একাধিক ঘটে যায় আর ঘটে চলেছে। এসব বন্ধ হবে কিনা প্রশ্ন সেটাই। যদিও সে প্রশ্নের সদুত্তর মেলা দুষ্কর।
( এখানে যে সব মহাকাব্যের কথা উল্লেখ আছে সে গুলি মূল মহাকাব্য ও তাঁর একাধিক ব্যাখ্যা মূলক লেখা পড়েই বলা)।
ইস্ক্রা রায়
You might also like
On-Sale Books
-
Karl Marx: Jibon O Manan
₹ 300Original price was: ₹ 300.₹ 255Current price is: ₹ 255. -
Gorakhpur Hospital Tragedy: Ek Chikitsaker Kalame Bhayabaha Biparjayer Smritilikhan
₹ 450Original price was: ₹ 450.₹ 382Current price is: ₹ 382. -
The Talking Camps: Language, Violence and Resistance in Migration
₹ 700Original price was: ₹ 700.₹ 560Current price is: ₹ 560. -
Constitutional Values and Fundamental Duties
₹ 75Original price was: ₹ 75.₹ 60Current price is: ₹ 60. -
Swadhinata Uttar Bharat: 1947-2022
₹ 325Original price was: ₹ 325.₹ 276Current price is: ₹ 276. -
Bharatiyo Gyan Parampara: Eitijyer Anusandhan
₹ 125Original price was: ₹ 125.₹ 107Current price is: ₹ 107.